শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪৫ পূর্বাহ্ন

বেটার নরমাল, স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা

বেটার নরমাল, স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা

মীযানুল করীম:

‘করোনাকাল’ চলছে বছরের গোড়া থেকেই। পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে নিচ্ছে করোনার মহাতাণ্ডব। এ কারণে এখন দেশে দেশে সরকারি বেসরকারিভাবে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে কয়েকটি শব্দ। যেমন ভাইরাস, টেস্ট, মাস্ক, গ্লাভস, আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, কোয়ারেন্টিন স্যানিটাইজার, প্যানডেমিক, কিট, অ্যান্টিবডি প্রভৃতি। সর্বশেষ এ সারিতে দেখা যাচ্ছে হার্ডরিয়ালিটি ও নিউ নরমাল।

তালিকার সবার শেষে যে শব্দটি রয়েছে, সেই ‘নিউ নরমাল’ নিয়েই যত কথা। এই শব্দটির অর্থ, ‘নয়া স্বাভাবিক’। মানে, করোনা মহামারীর জের ধরে গোটা দুনিয়াতে জীবনের সব ক্ষেত্রে যে আমূল রূপান্তর ঘটেছে কিংবা যে বিরাট বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে তাকেই ‘ব্যতিক্রমী’ না ধরে ‘স্বাভাবিক’ বা ‘প্রমিত’ (standard) মনে করা এবং সে মোতাবেক ইহজীবন কাটানো। এ নীতি মোতাবেক সর্বত্র ও সর্বদাই মাস্ক পরা, হাত না মিলানো, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, অনলাইনে ক্লাস করা ও সেমিনারের আয়োজন, প্রিন্টের চেয়ে ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মিডিয়াকে বেশি গুরুত্ব প্রদান, প্রভৃতি কাজকে জীবনের জন্য অনিবার্য বাস্তবতা কিংবা একান্ত অপরিহার্য মনে করতে হবে। অফিস-আদালত, দোকান-বাজার, অনুষ্ঠান, বিনোদন, ঘর-সংসার, লেখাপড়া, সাহিত্য ও শিল্পচর্চা- সবক্ষেত্রেই নিউ নরমালের বিষয় হাজির।
কিন্তু যা ‘নতুন’, সেটিই কি ‘উন্নত’? নিশ্চয়ই নয়। এমনকি সেটা যে অবিকৃত বা স্বাভাবিক ও সঙ্গত হবে, তা-ও চোখবুজে সব ক্ষেত্রে বলে দেয়া সম্ভব হয় না।

এ কারণে একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক তার কলামে করোনাঘটিত অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘ভেবেছিলাম মানুষ বদলাবে। পুরোপুরি না হোক, অনেকটা দূর হবে হিংসাবিদ্বেষ, ঈর্ষাপরায়ণতা; নষ্টামি আর ভণ্ডামি। ন্যায়নীতির পক্ষে অবস্থান বাড়বে। মানুষ বদলাচ্ছে। কিন্তু স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে না। বাড়ছে হিংসাবিদ্বেষ; কমেনি খুন খারাবিও। বিশ্ব পড়েছে নতুন চ্যালেঞ্জে।… কেউ জানে না, করোনাকাল কবে শেষ হবে। সব কিছু কবে স্বাভাবিক হবে। বুঝেও বুঝছি না আমরা। কৃত্রিম স্বাভাবিকতা নিয়ে চলছি।’ এখানে সবশেষে বলা হয়েছে ‘কৃত্রিম স্বাভাবিকতা’র কথা, যাকে বলতে হয় ‘আর্টিফিশিয়াল নরমাল’।
এ দিকে ইউনেস্কোর একটি প্রচারণা কোনো কোনো আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের এই অঙ্গ সংস্থাটি শুধু নিউ (নতুন) নয়, বেটার (উত্তম) নরমাল চায় মানবজাতির কল্যাণের স্বার্থে। কারণ ‘আধুনিক’ হলেই তা মঙ্গলজনক হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তেমনি নতুন কিছু হলেই যে সেটা উপকারী হবে, তার গ্যারান্টি পাওয়া যায় না। এরই মধ্যে আলজাজিরার মতো বিশ্বখ্যাত মিডিয়া ইউনেস্কোর এ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।

বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ শিশু আজও স্কুলে যায় না। এই যেতে না পারার উল্লেখ করে ইউনেস্কো বলেছে, কয়েকটি ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে চলমান মহামারী। তেমনি শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও তথ্য আনতে পারে মানবজাতির জন্য Better Normal বা উত্তম স্বাভাবিক অবস্থা। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি নতুন যা, তাকেই অন্ধের মতো জড়িয়ে ধরব ভালো-মন্দ বিচার না করে?

‘কাভার্ডভ্যান’ ধরনের বিরাট যানগুলো একেকটা যেন যন্ত্রদানব ও মৃত্যুদূত। তবে ওদের গায়ে লেখা আছে, ‘নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন’। একইভাবে মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের সাইটে লেখা থাকে, Safety First (নিরাপত্তাই প্রথমে)। অথচ আমরা করোনাকালেও নিরাপদ দূরত্বে থাকি না, নিজের নিরাপত্তাকেও করি তুচ্ছজ্ঞান।

কথা হলো, করোনা জীবাণুর সংক্রমণ রোধে ভ্যাকসিন কখন আসবে ঠিক নেই। তবে আশার কথা, ‘ফেসমাস্ক করোনার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের মতোই কাজ করে।’ নিশ্চয়ই একটা মাস্ক কেনার পয়সা সবার আছে। উপরের অভয়বাণীটি প্রকাশিত হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনি ভার্সিটির নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনের সম্পাদকীয়তে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, করোনাভাইরাসের তাণ্ডব কমতে পারে। তবে এ মহামারী সহজে দূর হবে না। বরং মানবজাতিকে আরো বড় বিপদের মোকাবেলার জন্য তৈরি থাকতে হবে।’ সংস্থাটি তিনটি ‘সি’ (প)-র ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। বলেছে, করোনায় সংক্রমণ আর মৃত্যুর হার কমলেই আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু বলেছে, উল্লিখিত ‘সি’ ত্রয় হলো Closed area, Crowded place আর Close contact অর্থাৎ আবদ্ধ স্থান যেখানে লোকজনের সংখ্যা বেশি; জনসমাগমপূর্ণ স্থান এবং পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য (‘সামাজিক দূরত্ব’ না মানা)। WHO-এ তিনটি পরিহার করে চলতে বলেছে সবাইকে। আরো জোর দিয়েছে বিশেষত মাস্ক পরা, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজার ব্যবহারের বিষয়ে। এ দিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে বিষোদগার এবং গায়ের ঝাল ঝাড়া অব্যাহত রেখেছেন।

বাংলাদেশের মানুষ সব কিছুকে Positively নেয়। ব্যঙ্গ করে একজন লেখক এটি বলেছেন সম্প্রতি। করোনাকালেও মানুষ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করায়- বিশেষত মাস্ক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় তিনি এ কথা লিখেছেন তার কলামে। সত্যিই করোনার টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ হলেও লোকজনের যেন পরোয়া নেই। অনেকেই পরামর্শ দেন- সব কিছুকে ‘পজিটিভলি’ দেখতে এবং কোনো ব্যাপারেই নেগেটিভ চিন্তা না করার জন্য। এখন সেটা যে এমন উদ্ভটভাবে কার্যকর হবে, কে জানত।

এ দেশের মানুষের পেটে খাবার না থাকতে পারে। তবে পেটভরা হাস্যরসের কমতি নেই। তাই মাস্ককে কেউ কানে পেঁচিয়ে রাখেন। কেউবা খুতনি বরাবর ঝুলিয়ে ধুমসে সিগারেট ফুঁকছেন। আবার কেউ কেউ মাস্ক থাকলেও তা পকেটে পুরে রাখেন। অনেকের কাছে মাস্ক পরতে হবে ফ্যাশনের অংশ হিসেবে; স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য নেয়। তাই নানান রঙ ও ছাপের মাস্ক বেরিয়েছে। এমনকি ডেনিমেরও। কিন্তু যত রঙচঙা ও আকর্ষণীয় মুখোশ পরি না কেন, তাতে কি মুখের আসল ভাবভঙ্গি দূর করা যায়? আমরা তো মাস্ক বা মুখোশ দিয়ে সাময়িকভাবে ফেস বা মুখ লুকাতে চাচ্ছি মাত্র। তবে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন স্থায়ীভাবে আসছে না আমাদের মধ্যে। এ জন্যই জাতীয় কবি নজরুল বলেছেন, ‘মন না রাঙায়ে কেন বসন রাঙালে, হে যোগী?’
এখন হররোজ পত্রিকায় টিভিতে ভ্যাকসিন সংবাদ। মানে করোনার ভ্যাকসিন-সংক্রান্ত বার্তা। কখনো গবেষণা, কখনো উদ্ভাবন, কখনোবা ট্রায়ালের খবর। মাঝে মধ্যে আশা জাগে, এই বুঝি ভ্যাকসিন চলে এলো। আর ভাবনা নেই কোভিড নিয়ে। মহামারী তার নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবুক। আবার অনেক সময় হতাশ হয়ে ভাবি, করোনার ভ্যাকসিন বের হলেওবা আমাদের কী লাভ? মহামারীতে যারা চলে গেছেন, তারা আর কোনো দিন ফিরবেন না। আর ভ্যাকসিন আবিষ্কারই শেষ কথা নয়। এটি নিরাপদ, কার্যকর, পরিবেশবান্ধব কি না- কে জানে? বাংলাদেশের মতো গরিব রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ এই অসাধারণ জিনিস কি হাতের কাছে পাবে? এটি কি গণমানুষের কেনার সীমার ভেতর থাকবে? কেউ বলছেন, সামনের শীতেই চলে আসবে করোনার মহৌষধ। অনেকে বলছেন, তখন করোনা মহামারী বাড়বে। কারো মতে, ২০২১ সালের প্রথম দিকে তা বাজারে আনা সম্ভব হবে। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ প্রধান বললেন, অন্তত দেড় বছরের আগে এ দেশ ভ্যাকসিনটা পাবে না।

‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।’ যখন আসবার তখন আসবে করোনা ভ্যাকসিন। তার আগে নিজেরা সাধ্যমতো স্বাস্থ্যবিধি মানব না কেন? আল্লাহ তায়ালা বলেছেন মানুষকে সাধ্যমতো চেষ্টা করতে। ফলাফল কেবল তাঁর হাতে। বসে বসে ভয়ে কাঁপার চেয়ে কি হাত-পা নাড়াচাড়া করা উত্তম নয়?

বহু জায়গায় দেখা গেছে, লেখা আছে নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচান। মাস্ক পরুন; মেনে চলুন স্বাস্থ্যবিধি।’ না, আমরা জাতি হিসেবে কোনো বিধিবিধানের বোধহয় ধার ধারি না, তাই নিজেও বাঁচতে চাই না, অন্যকে বাঁচানো দূরের কথা। ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার মতো অসামাজিক কাজ তাই আমরা করতে চাই না। মৃত্যুঝুঁকি নিতে রাজি; তবুও স্বাস্থ্যবিধি নয়।

পুনশ্চ : মাস্কের বিরুদ্ধে মারমুখো জনতার বিক্ষোভ ইউরোপ ও আমেরিকায়; মাস্ক নিয়ে মশকারি চলছে বাংলাদেশেও। কিন্তু পাশ্চাত্যে মাস্ক নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যত ঠাট্টা করুন, প্রাচ্যের ইন্দোনেশিয়ায় এর বিপরীত। সে দেশেও অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে আগ্রহী নন। তাই মাস্ক ছাড়াই জনসমক্ষে বের হচ্ছেন। কয়েক দিন আগে পত্রিকার ছবিতে দেখা গেছে, এক ব্যক্তি মাস্ক না পরায় তাকে প্রকাশ্য রাজপথে কফিনে শুয়ে থাকতে হয়েছে। তখন কৌতূহলী জনতা তার অবস্থা দেখছিল। এবার বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রটিতে মুখে মাস্ক না দেয়ার সাজা, আস্ত কবর খোঁড়া। এখন আর কফিনে শুয়ে লাশের অভিনয়ই যথেষ্ট নয়।
সাত হাজার দ্বীপের এ দেশে মাস্ক না পরাকে নিয়মের ব্যতিক্রম বলে গণ্য করে এই অপরাধের জন্য শাস্তিও দেয়া হচ্ছে ব্যতিক্রমী পন্থায়। কয়েকজন বেপরোয়া ব্যক্তি মাস্ক না পরার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। ইন্টারনেট থেকে জানা যায়, ওদের শাস্তি কবর খনন করা। যেসব লোক করোনা মহামারীতে প্রাণ দিয়েছেন, তাদের জন্যই এসব কবর খুঁড়তে হবে। জাভা দ্বীপে এ ঘটনা ঘটেছে। রাজধানী জাকার্তা এ দ্বীপেই। শাস্তিপ্রাপ্ত দু’জন করে একেকটি কবর খোঁড়ার কাজে লাগানো হয়েছিল।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877